পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের পূর্ব নির্ধারিত নক্শা বা চিত্র। এর ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠানের সকল স্তর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত । একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গৃহীত হয় । বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতেও পরিকল্পনাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে । নিম্নে রেখাচিত্রের সাহায্যে পরিকল্পনার শ্রেণিবিন্যাস দেখানো হলো :
রেখাচিত্রে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচিত হলো :
পরিকল্পনাকে তার প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয় । নিম্নে এগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. লক্ষ্য (Goals) : পরিকল্পনার অভিপ্রেত ফলকে লক্ষ্য বলে । এরূপ অভিপ্রেত ফল বা লক্ষ্যার্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানের সকল উপায়-উপাদান ও কর্মপ্রচেষ্টাকে কাজে লাগানো হয় । কোনো প্রতিষ্ঠানে ১০% উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা এরূপ লক্ষ্যের একটি উদাহরণ। সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি লক্ষ্য ঠিক করা হয় এবং তার আলোকে বিভিন্ন বিভাগ বা স্তরে অধি-লক্ষ্য (Sub-Goal) নির্ধারণ করা হয় । পরিধি ও প্রকৃতি অনুযায়ী লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য, মিশন, সময় লক্ষ্য, বাজেট লক্ষ্য বা কোটা, টার্গেট ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। (পরিকল্পনার লক্ষ্য শিরোনামের আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
২. স্থায়ী পরিকল্পনা (Standing plan) : যে পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানে একবার গৃহীত হওয়ার পর নতুন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা নতুন কোনো অবস্থা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তা বারবার ব্যবহৃত হয় তাকে স্থায়ী পরিকল্পনা বলে । একই ধরনের সমস্যা বা অবস্থা মোকাবেলার জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণীত হয় এবং বারে বারে তা ব্যবহৃত হয় । ফলে উর্ধ্বতনদের যেমনি নতুন নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা অধস্তনদের জানানোর প্রয়োজন পড়ে না তেমনি অধস্তনরা একই পরিকল্পনার আওতায় কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভুলের সম্ভাবনা হ্রাস পায় । যা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে । এরূপ পরিকল্পনা নিম্নোক্ত কয়েক ধরনের হতে পারে :
i) নীতি (Policy) : একই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বনির্ধারিত আদর্শ বা সাধারণ নির্দেশনাকেই নীতি বলে । সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও কার্যসম্পাদনে নীতি ব্যবস্থাপকদের বিশেষভাবে সহায়তা করে । কোনো প্রতিষ্ঠানে নগদ বিক্রয়ের নিয়ম বা জ্যেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রদান-এরূপ নীতির উদাহরণ ।
ii) প্রক্রিয়া (Process) : লক্ষ্যার্জনে পরস্পর নির্ভরশীল ধারাবাহিক কার্যসমষ্টিকে প্রক্রিয়া বলে । প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কার্যসমূহ একের পর এক নির্দিষ্ট থাকে । পরস্পর নির্ভরশীল থাকায় একের কাজ দ্বারা অন্যে প্রভাবিত হয় । সকল কাজের সফল সম্পাদন লক্ষ্যার্জন নিশ্চিত করে । কর্মী নির্বাচনের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ হতে শুরু করে নিয়োগ দান পর্যন্ত কর্মসমষ্টিকে প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে ।
iii) পদ্ধতি (Procedure) : প্রক্রিয়ার অধীনে নির্ধারিত প্রত্যেকটি কার্য সম্পাদনের জন্য গৃহীত কার্যক্রমকে পদ্ধতি বলে । কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ একটা অন্যতম উপায় বা পদ্ধতি । এই লিখিত পরীক্ষা কিভাবে নেয়া হবে-এ সম্পর্কিত নিয়মকে পদ্ধতি বলা যায় ।
iv) কৌশল (Technique) : কৌশল হলো এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরিকল্পনা । প্রতিযোগী ফার্ম কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনাকে কিভাবে মোকাবিলা করা হবে তার জন্য পূর্বনির্ধারিত নীতিকে কৌশল বলে। উৎপাদিত দ্রব্য সরাসরি ভোক্তাদের নিকট সরবরাহের নীতি- কৌশলের একটি উদাহরণ ।
৩. একার্থক পরিকল্পনা (Single-use plan) : যে পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র একবার ব্যবহারের জন্য বা একটি মাত্র উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রণয়ন করা হয় তাকে একার্থক পরিকল্পনা বলে । যে সকল কার্যক্ষেত্রে অবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হয় বা ফরমায়েশ অনুযায়ী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সেখানে একার্থক পরিকল্পনা উত্তম বিবেচিত হয়ে থাকে । প্রতিষ্ঠানে কোনো বিশেষ অবস্থা মোকাবেলার জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতে পারে । প্রতিষ্ঠানে কিছু যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন মেরামত না করার কারণে নষ্ট হওয়ায় যথেষ্ট শ্রম ঘণ্টার অপচয় হচ্ছে এরূপ অপচয় একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য গৃহীত বিশেষ কর্মসূচি এরূপ পরিকল্পনার উদাহরণ । সময়ের অভাবে এরূপ পরিকল্পনার পরিবর্তন আনা অনেকসময়ই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে । এ ধরনের পরিকল্পনাকে দু'টি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়; যা নিম্নরূপ :
i) কর্মসূচি (Programme) : কোনো বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে বড় ধরনের পরিকল্পনা গৃহীত হয় তাকে কর্মসূচি বলে । বাংলাদেশের খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণ রোধ করার জন্য গৃহীত বড় ধরনের পরিকল্পনা এর উদাহরণ । পোলিও রোগ নিরূপণের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা, প্রতিষ্ঠানের পুরনো সকল যন্ত্রপাতি সরিয়ে নতুন যন্ত্রপাতি বসানোর পরিকল্পনাকে কর্মসূচি বলা যায় ।
ii) প্রকল্প (Project) : কর্মসূচির আওতায় বিশেষ বিশেষ কার্য সম্পাদনের প্রতিটা পরিকল্পনাকে প্রকল্প বলে । আর্সেনিক দূষণ রোধে অনেকগুলো পরিকল্পনার সাথে দূষণযুক্ত টিউবওয়েল শনাক্তকরণের পরিকল্পনাকে একটা প্রকল্প হিসেবে গণ্য করা যায়। একাধিক শ্রেণিবিন্যস্ত তালিকার মধ্য থেকে ক তালিকাভুক্ত যন্ত্রপাতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনঃসংস্থাপনের কার্যক্রমকে প্রকল্প হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে ।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মেয়াদের ভিত্তিতেও পরিকল্পনা গৃহীত হতে দেখা যায়। এরূপ ভিত্তিতে পরিকল্পনাকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায় :
১. স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা (Short-term plan) : সাধারণত এক বৎসর বা তার কম সময়ের জন্য গৃহীত পরিকল্পনাকে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বলে । প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় ও উপবিভাগীয় পর্যায়ে যে সকল পরিকল্পনা গৃহীত হয় তা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার উদাহরণ । বার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় ত্রৈমাসিক, মাসিক বা সাপ্তাহিক পরিকল্পনার সবগুলোকেই এ ধরনের পরিকল্পনা গণ্য করা যায় ।
২. মধ্যমমেয়াদি পরিকল্পনা (Mid-term plan) : এক বৎসরের অধিক ও সর্বোচ্চ পাঁচ বৎসর সময়ের জন্য গৃহীত পরিকল্পনাকে মধ্যমমেয়াদি পরিকল্পনা বলে । ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট লেভেলে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ ধরনের মধ্যম মেয়াদি পরিকল্পনা গৃহীত হতে দেখা যায় । সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এর একটি উদাহরণ ।
৩. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা (Long-term plan) : পাঁচ বৎসরের অধিক যেকোনো সময়ের জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা গৃহীত হয় । ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে যে স্ট্র্যাটিজি নির্দিষ্ট করা হয় তা এ ধরনের পরিকল্পনার উদাহরণ । কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহ যে সকল স্ট্রাটিজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে- তা এর মধ্যে পড়ে । বাংলাদেশ সরকারের Vision 2021 এর ঘোষণা এর অন্তর্ভুক্ত ।
প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোর কোন পর্যায়ে কোন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে তা অনুসারেও পরিকল্পনাকে ভাগ করা যায়; যেগুলো নিম্নরূপ :
১. স্ট্র্যাটিজিক বা কৌশলগত পরিকল্পনা (Strategic plan) : তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তমূলক কোনো পরিকল্পনা গ্রহণকে স্ট্র্যাটিজিক পরিকল্পনা বলে । স্বাভাবিকভাবেই এরূপ পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্বাহীদের কর্তৃক দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা সহযোগে প্রণীত হয় । এরূপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংগঠনের নিচের স্তরে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে । প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পণ্যসারিতে নতুন ১০টি আইটেম অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে-এটি স্ট্র্যাটিজিক পরিকল্পনার উদাহরণ ।
২. কার্যভিত্তিক পরিকল্পনা (Functional plan) : প্রতিষ্ঠানের স্ট্রাটিজিক বা কৌশলমূলক পরিকল্পনার আলোকে প্রতিষ্ঠানের মধ্য ও নিম্ন পর্যায়ে স্বল্প সময়ের জন্য বাস্তবায়নমূলক যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাকে কার্যভিত্তিক পরিকল্পনা বলে । এরূপ পরিকল্পনা সাধারণত নিম্নরূপ হয়ে থাকে:
ক. বিভাগীয় পরিকল্পনা (Departmental plan) : প্রতিষ্ঠানের পৃথক পৃথক বিভাগের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে তাকে বিভাগীয় পরিকল্পনা বলে । কার্যভিত্তিক বিভাগ খোলা হলে সেক্ষেত্রে উৎপাদন, ক্রয়, বিক্রয় ইত্যাদি বিভাগের জন্য প্রণীত পরিকল্পনা এর মধ্যে পড়বে। এরূপ বিভাগের অধীন উপবিভাগ ও কর্মকেন্দ্রের পরিকল্পনাও এর অধীন । দ্রব্যভিত্তিক বিভাগ খোলা হলে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন দ্রব্যভিত্তিক বিভাগের গৃহীত পরিকল্পনা-এ ধরনের পরিকল্পনা বিবেচিত হবে ।
খ. আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Regional plan) : যে সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত থাকে সেক্ষেত্রে আঞ্চলিকভাবেও পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় । বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ তাদের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা নিলে তা আঞ্চলিক পরিকল্পনা হিসেবে গণ্য হয়। একটা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় বিভাগ বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য জোনাল পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে ।
গ. মাস্টার বা সামগ্রিক পরিকল্পনা (Master plan) : কোনো প্রতিষ্ঠানের সকল বিভাগ বা অঞ্চলের পরিকল্পনাকে একত্রিত করে যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় তাকে সামগ্রিক বা মাস্টার পরিকল্পনা বলে। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগীয় বাজেট সমন্বয়ে ‘মাস্টার বাজেট' তৈরি এরূপ সামগ্রিক পরিকল্পনার উদাহরণ ।
প্রকল্প
নিয়ম
বাজেট
প্রক্রিয়া
আরও দেখুন...